Breaking news

২৫শে মার্চ: জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ
২৫শে মার্চ: জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ

২৫শে মার্চ: জাতীয় গণহত্যা দিবস আজ

আজ গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর নরপিশাচের হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঢাকা শহরকে পরিণত করেছিল শ্মশানে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, তরুণ, ছাত্র, শিক্ষক কেউই রেহাই পায়নি নরঘাতকদের হাত থেকে। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে শহরের বুকে নেমে এসেছিল জলপাই রঙের ট্যাংক। মর্টার মেশিনগান দিয়ে তারা হত্যা করেছিল লাখো বাঙালিকে। ইতিহাসের ভয়ালতম এ গণহত্যার নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের বন্দিশিবিরে, ভিয়েতনামে, কম্বোডিয়ায়, জাপানিদের দ্বারা চীনের নানচিং শহরে এবং মানব ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে যে নারকীয় হত্যাকা- হয়েছে ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশেও অনুরূপ জঘন্য হত্যাকা- চালানো হয়। বস্তুত ২৫ মার্চ থেকে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালির ওপর সংঘটিত হত্যাকা- ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকা-, যা অতীতের সব দেশের সব জাতির ওপর সংঘটিত হত্যাকা-কে পৈশাচিকতায় হার মানায়। গত ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরে মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদন করা হয়। দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের বিষয়ে জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত সংস্থার কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ববাংলার মানুষের ওপর নানারকম বৈষম্য, শোষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় পূর্ববাংলার জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা করতে থাকে। এদের সঙ্গে হাত মিলান পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল পিপিপির প্রধান জুলফিকার আলি ভুট্টো।

১৯৭১ সালের মার্চে বাঙালির ন্যায্য দাবিতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই আহ্বানে জেগে ওঠে পূর্ববাংলার সর্বস্তরের মানুষ। এদিকে বাঙালিকে দমন করতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। তার মানে তারা ষড়যন্ত্র করে যে, পূর্ববাংলার ভূমি ও সম্পদ তাদের দরকার কিন্তু মানুষ দরকার নেই। তারা পুর্ববাংলার মানুষকে গণহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চক্রান্ত করে। পূর্ববাংলায় শাসক করে পাঠানো হয় কুখ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে।

১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে থাকেন। যদিও এই আলোচনা ছিল বাঙালির চোখে ধুলো দেওয়ার একটি কৌশল। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে পূর্ববাংলায় আনা হতে থাকে রাশি রাশি অস্ত্র আর ঘাতক সৈন্য। ২০ মার্চেই অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।

২৫ মার্চের সন্ধ্যায় গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন দুই কুচক্রী ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলি ভুট্টো। ইয়াহিয়া সন্ধ্যায় আর ভুট্টো পরদিন ২৬ মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন।

ক্র্যাকডাউন হতে পারে এ আশঙ্কায় মুক্তিকামী জনতা ফার্মগেটসহ কিছু কিছু এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। তবে এমন ব্যাপক বিধ্বংসী গণহত্যা যে হতে পারে সেটা কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।

পঁচিশে মার্চে রাত ১০টার পর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে ট্যাংকবহর। বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদের নিরস্ত্র করা হয়। অবাঙালি সৈন্যরা পুরো বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করতে চুপিসারে ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা শহরে। অপারেশন সার্চলাইট নামের ওই হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা অনুযায়ী দুটি সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর তত্ত্বাবধানে প্রথম সদর দপ্তরটি গঠিত হয়। এখানে ৫৭তম ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে শুধু ঢাকা নগরী ও তার আশপাশের এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর জেনারেল খাদিম রাজাকে পূর্ববাংলার বাকি অঞ্চলগুলো অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অপারেশনের সার্বিক দায়িত্বে থাকেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।

রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় গণহত্যা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্যাংক ও লরিতে সৈন্যরা প্রবেশ করে। মর্টারের গোলা এসে পড়ে তৎকালীন ইকবাল হলে। হলের শতাধিক ছাত্র মৃত্যুবরণ করেন। তারপর শুরু হয় হলের ভেতর ঢুকে ছাত্রদের গণহারে হত্যা। মেশিনগানের গুলি, বেয়োনেট চার্জ চলতে থাকে। জগন্নাথ হলের ভেতরে ঢুকে শত শত ছাত্রকে হত্যা করা হয়। কর্মচারী ও শিক্ষকরাও বাদ যান না। সেই রাতেই শহীদ হন প্রখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের ৯ অধ্যাপক। সেই রাতে মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক মধুসূদন দেসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী, কর্মকর্তারা সপরিবারে শহীদ হন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশপাশের সব বস্তি, রাস্তায় ঘুমন্ত মানুষ কেউ রেহাই পায়নি। মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলেও কামানের গোলা ছুড়ে অনেক মানুষ হত্যা করা হয়। ভাষা আন্দোলনের স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ধ্বংস করে ফেলা হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ইপিআর সদর দপ্তরে নৃশংস হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর জওয়ানদের। তবে পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা সেনাবাহিনীর আক্রমণ ঠেকাতে বীরোচিত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তারা বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেনাবাহিনীর বাঙালিরাও তাৎক্ষণিক জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে পাকিস্তানিদের রুখে দাঁড়ান।

২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হয়। আর সেই রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর থেকেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ।

Published: 2021-06-29 09:17:44   |   View: 1331   |  
Copyright © 2017 , Design & Developed By maa-it.com



up-arrow